ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যখন নাতি-নাতনীদের নিজের অবিশ্বাস্য এক ক্যারিয়ারে বীরত্ব মাখা গল্প শোনাবেন তখন খুব সম্ভবত সবার আগে চলে আসবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কথা কেননা এই ক্লাবটাই যে তাকে বানিয়েছে বিশ্বসেরা, শিখিয়েছে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা। কিন্তু বছর খানেক আগেও যে ভালো লাগা নিয়ে মধুর এই অধ্যায়ের কথা রোনালদো বলতে পারতেন সেই ভালো লাগা কি আগের মতো থাকবে? থাকার কথা না, যা ঘটেছে বা ঘটছে তাতে রোনালদোর কাছে শেষ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দ্বিতীয় অধ্যায়টা হয়ে থাকতে পারে এক কালো অধ্যায় যা রোনালদো বীরত্বের মাঝে এনে দিতে পারে মলিনতা!
এই মৌসুমের শুরু থেকেই রোনালদোকে নিয়ে চলছিলো নানা গুঞ্জন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড চ্যাম্পিয়নস লীগের টিকিট কাটতে না পারায় রোনালদো নাকি যেতে চেয়েছিলেন অন্য ক্লাবে, তবে নতুন কোচ টেন হ্যাগ এসে বলেছিলেন রোনালদো তার পরিকল্পনার বড় একটি অংশ তাই রোনালদোকে যেতে দেয়া হবে না খুব সহজে। তবে কোচের মুখের কথা আর কাজে যথেষ্ট মিল না থাকায় রোনালদো ছিলেন যথেষ্ট হতাশ যার পরিপূর্ণ প্রকাশ পায় মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই। গত মৌসুমে যে রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে নিজের কাধে করে টানছিলেন সেই রোনালদোকেই নিয়মিতভাবে বসে থাকতে হয়েছে সাইড বেঞ্চে। টেন হ্যাগের রোনালদোর প্রতি অবিশ্বাস নাকি রোনালদোর ফর্ম ভালো না সেটা নিয়ে যথেষ্ট তর্ক হয়েছে এবং রোনালদোর সাথে যে কোনোভাবেই টেন হ্যাগের বুনছিল না তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচে রোনালদো আগেই মাঠ ত্যাগ করা এবং সেই কারণে রোনালদোকে পরের ম্যাচের স্কোয়াডে না রাখা। এখানেই শেষ নয়, শাস্তি হিসেবে রোনালদোকে বাধ্য করা হয়েছিলো ম্যানইউর অনুর্ধ্ব ২১ দলের সাথে অনুশীলন করতে যেটা রোনালদোর মতো গুরুগম্ভীর লোকের জন্য একটা বড় ধরনের অপমান বললে খুব একটা ভুল হবে না।
এতোকিছুর পরেও রোনালদো ছিলেন চুপচাপ। বোঝাই যাচ্ছিলো মেঘের গর্জনের আগে যে ভারী পরিবেশের সৃষ্টি হয়, রোনালদোর চুপচাপ থাকাটাও তারই আভাস। তবে শেষে রোনালদোর সেই নিরবতা ভাঙলো। তুমুল বেগে ফুটবল পাড়ায় নেমে এলো বৃষ্টি, যে বৃষ্টিতে রোনালদো নিজে ভিজেছেন, তার ভক্তদের ভিজিয়েছেন এবং ভিজিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে!
সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রোনালদো যথারীতি বোমা ফাটিয়েছেন, যেখানে তিনি শুধু ম্যানইউ কোচের বিরুদ্ধে নয়, প্রশ্ন তুলেছেন গোটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে। এমন কি নিজের পরিবারের প্রতিও অসম্মান জানিয়েছে ম্যানইউ এমন দাবি করেছেন রোনালদো!
রোনালদো ও ম্যানইউকে নিয়ে চলা নানা গুঞ্জনের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রোনালদো সরাসরি বলে দিয়েছেন, “ম্যানইউ আমাকে অপমান করেছে। শুধু কোচ নয়, ম্যানইউর অনেকেই আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিলো। শুধু এই মৌসুমে নয়, গত মৌসুমেও তারা চেয়েছিল আমাকে দলে না রাখতে।”
কোচের সাথে যে দ্বন্দ্বের কথা বাতাসে ভাসছিলো সেটা নিয়ে রোনালদোর সরাসরি উত্তর, “টেন হ্যাগের প্রতি আমার কোন সম্মান নেই কারণ তিনি আমার প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি।”
তাহলে সমস্যাটা শুধুই কোচের সাথে? নাকি রোনালদোর ক্ষোভের কারণ আছে আরো? এই প্রসঙ্গেও খোলামেলা উত্তর রোনালদোর! তিনি বলেন, “স্যার ফার্গি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পরে এই ক্লাবের উন্নতির খাতা একদম ফাঁকা, সোজা কথায় শূন্য। এখানে এখনো সেই ধরনের প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যা আমি ২০ বছর বয়সে এখানে দেখে গিয়েছিলাম। তাদের ভিতর উন্নতির কোন চেষ্টা নেই যেটা এই সময়ে ম্যানসিটি, লিভারপুল এবং আর্সেনালের মতো ক্লাব করেছে। তারা জানে না কিভাবে একজন খেলোয়াড়কে সম্মান দেখাতে হয়। আমার কাছে আমার পরিবার সবার আগে এবং আমার সন্তান অসুস্থ ছিলো যার কারণে আমি প্রি সিজন ম্যাচগুলোতে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি কিন্তু ম্যানইউ এই বিষয়টিকেও সন্দেহ করেছে।”
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসার আগে একটা বড় গুঞ্জন ছিলো ম্যানসিটিতে যাচ্ছেন রোনালদো। কিন্তু সেই সময় ম্যানইউকে কেন বেছে নিলেন রোনালদো? কেননা সেই সময়ে ম্যানইউর থেকে অনেক ভালো অবস্থায় ছিল ম্যানসিটি এবং সেই সময়ে ম্যানসিটিকে বেছে নিলে হয়তো রোনালদোকে ইউরোপা লিগও খেলতে হতো না! তবে রোনালদো দাবি করেছেন তিনি শুনছেন মনের কথা। রোনালদো বলেন, “স্যার ফার্গি আমাকে বলেছিলেন তুমি ম্যানসিটিতে যেতে পারো না এবং এর উপরে আমি বলেছিলাম আচ্ছা স্যার। আমি আমার হৃদয়ের কথা শুনেছি এবং আমি সবসময় ম্যানইউকে সেরা অবস্থানে দেখতে চেয়েছি, তাই এখানে এসেছি, কিন্তু এখানে এসে দেখেছি তাদের মধ্যে সেরা হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।”
ম্যানইউ নিয়ে এতো ক্ষোভের কথা বললেন কিন্তু এই ক্ষোভ কি ম্যানইউ ভক্তদের প্রতি রোনালদোর আছে? রোনালদোর সরাসরি উত্তর, মোটেই না। তিনি বলেন, “আমি ম্যানইউকে ভালোবাসি এবং এই দলের ভক্তদেরও ভালোবাসি, তারা সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি আমাদের ছেলের মৃত্যুর পর লিভারপুলের ভক্তরা যেভাবে আমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তা ছিলো অবিশ্বাস্য এবং আমি কখনোই এমনটা ঘটবে বলে প্রত্যাশা করিনি।”
শেষটা ভালোবাসার গল্প দিয়ে হলেও যে পরিমাণ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে বিশ্বকাপের পর আর ম্যানইউর জার্সিতে দেখা যাবে রোনালদোকে? উত্তরটা কৌশলের সাথেই দিলেন রোনালদো, “আমি চাই ম্যানইউ ভালো করুক, সেটা যদি আমাকে দিয়ে হয় তাহলেও ভালো এবং আমাকে ছাড়া হলেও ভালো। তবে ভালো কিছু পেতে হলে তাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে।”
রোনালদোর শেষ কথাটা মিষ্টি হলেও ম্যানইউর এরই মধ্যে রোনালদোর ক্লাবের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য নাকি ১ মিলিয়ন পাউন্ডের জরিমানা ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এমনটাই যদি হয় তাহলে বিশ্বকাপের পর রোনালদোকে অন্য কোনো ক্লাবে দেখার মানসিক প্রস্তুতিটা রোনালদো ভক্তরা এখনই সেরে রাখতে পারেন!